বাবলু আকন্দঃ ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার বনবাংলা গ্রামে জন্ম নেওয়া এনামুল হক একজন সাধারণ মানুষ নন। পেশায় তিনি দলিল লেখক ও সাংবাদিক হলেও, তার হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ মানবিক গুণ। ঘোরাঘুরি তার নেশা হলেও, আরেকটি ‘নেশা’ তাকে দিয়েছে আলাদা পরিচয় কবর খোঁড়া।
শুনতে অবাক লাগলেও, মৃত্যুর সংবাদ শুনলেই যিনি প্রথম ছুটে যান গোরস্থানের দিকে, তিনি এনামুল হক। শাবল আর কোদাল হাতে, নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থভাবে কবর খুঁড়তে শুরু করেন মৃতের জন্য। এলাকার ছোট-বড় যেই হোক না কেন, বিদায় জানাতে তিনি থাকেন সবার আগে। মৃত্যুর বিষাদঘন মুহূর্তে যখন সবাই শোকে নিথর, তখনই এনামুল হক হয়ে ওঠেন নির্ভরতার প্রতীক।
এ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক কবর খুঁড়েছেন তিনি, এক টাকাও নেননি কারও কাছ থেকে। বিনা পারিশ্রমিকে, নিছক ভালোবাসা থেকে করেন এই কাজটি। তার মুখে শোনা যায়, মানুষের শেষ ঠিকানাটা আমার হাত দিয়ে তৈরি হয়—এই অনুভূতিটা বলে বোঝানো যাবে না। প্রচণ্ড মানসিক শান্তি পাই।
এনামুল হকের এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও সেবার মনোভাব তাকে দিয়েছে আলাদা পরিচিতি। এলাকাবাসী তাকে ভালোবেসে ডাকেন ‘গোরস্থানের ফেরিওয়ালা’। কারো মৃত্যুর খবর ছড়ালেই প্রথম ফোন যায় এনামুলের কাছে। কখনো একা, কখনো বা কেউ সঙ্গে থাকে; কিন্তু কাজ শুরু করেন ঠিক সময়েই।
তার এই কর্মযজ্ঞে নেই কোনো আশা, নেই কোনো স্বীকৃতির প্রত্যাশা। শুধু ভালোবেসে মানুষকে বিদায় জানানোর প্রয়াস। এক অদ্ভুত টান কাজ করে তার মধ্যে। এই টানকে তিনি বলেন, “নেশা” কিন্তু এই নেশা আত্মধ্বংসী নয়, বরং মানবতার নির্মল রূপ।
এনামুল হকের এই কাজ যতটা কঠিন, ততটাই পবিত্র। শারীরিক শ্রম, ধুলোমাটি আর শোকের ভার, সবকিছু একসাথে বহন করে যাচ্ছেন তিনি নীরবে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর।
তিনি বলেন, জানি একদিন আমাকেও কেউ কবর দেবে। আমি চাই, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষকে ভালোবেসে যেতে, শেষ বিদায়টাতে একটু হাত বাড়িয়ে দিতে।
এই সমাজে যেখানে অনেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে এনামুল হকের মতো একজন মানুষ যেন মানবতার এক নিরব দীপশিখা। তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, মানবিকতার ছোঁয়া আর শেষ বিদায়ের কান্নার ভেতর থেকেও তিনি হয়ে উঠেছেন আশার আলো।
শুধু দলিল লেখক বা সাংবাদিক নয়, তিনি একজন জীবন্ত অনুপ্রেরণা। তার জীবন আমাদের শেখায়, মানুষকে ভালোবেসে, নিঃস্বার্থভাবে কিছু করতে পারা যায়, চুপচাপ… নিঃশব্দে… অমলিন শ্রদ্ধায়।
এনামুল হক নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবর খুঁড়েই যেতে চান। মৃত্যুকে সম্মান জানাতে, মৃতকে শ্রদ্ধা জানাতে, জীবিতদের শান্তি দিতে। আমরা যদি তার মতো কিছুটা হলেও ভালোবাসতে পারতাম মানুষকে, হয়তো এই পৃথিবীটা হতো একটু বেশি মানবিক।
এই সমাজে যেখানে মানুষ নিজের জন্যই হন্তদন্ত, সেখানে এনামুল হকের মতো মানুষেরা আমাদের শিখিয়ে দেন, ভালোবাসা, সহমর্মিতা আর নিঃস্বার্থ সেবা এখনো বেঁচে আছে।
0 Comments